বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা এবং ভারতের মালদা জেলা বরেন্দ্র ভূমির অন্তর্গত। বরেন্দ্র অঞ্চল মূলত ২৩-৪৮-৩০ উত্তর অক্ষাংশ ও ২৬-৩৮ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮-০২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ও ৮৯-৫৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। কর্কটক্রান্তি রেখা এ স্থানের সামান্য দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে গেছে। বরেন্দ্র শব্দের সরল ও ব্যাকরণসম্মত অর্থ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের বরে (বর+ইন্দ্র) অর্থাৎ অনুগ্রহ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে বরেন্দ্র এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ এগুলোকে ‘ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র’ বলা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম। পরীক্ষা করে দেখে দেখা গেছে, এ মাটিতে শতকরা মাত্র ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্র্থ রয়েছে। এ মাটিতে নাইট্টোজেন কম, ফসফরাস কম-মধ্যম, পটাশ, গন্ধক ও দস্তা কম-মধ্যম মানের রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বেলে বা বেলে দো-আঁশ জাতীয় মাটিতে নেই। এখানে লাল মাটি রয়েছে। পলি অঞ্চলে লাল মাটি দেখা যায় না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাড়ি (খাল) এবং পুকুর ছিল কিন্তু বর্তমানে এগুলো বেশিরভাগ মাছ চাষে লিজ দেয়া হয়েছে। এর কারণে সেখান থেকে পানি নিয়ে সেচ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া নদীর পানি শুকিয়ে সেচ কাজে বিঘ্ন হচ্ছে। এ এলাকায় চাষাবাদ করা কঠিন। এজন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে অনেক এলাকা চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু বেশি পানি তোলার কারণে এ এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাই বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার এ এলাকা নিয়ে বিশেষ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এর মধ্যে পাতকুয়া একটি। পাতকুয়া (Dugwell) হলো ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিম্ন পর্যন্ত গোলাকার আকৃতিতে মাটি খনন করে চারপাশ থেকে চুয়ানো পানি (Leaching water) ধরে রাখার আধার। পাতকুয়া হাজার বছরের পুরনো একটি প্রযুক্তি যা ব্যবহার করে মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য বালতির সাথে রশি বেঁধে পানি উত্তোলন করে তা খাবার ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করত।
কিন্তু আধুনিক পাতকুয়াটি মূলত একটি নতুন উদ্ভাবন। এ ধারনাটি বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপির। ধারণাটি বাস্তাবায়নের জন্য তিনি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলে তার নির্দেশক্রমে পাতকুয়া খনন করা হয়েছে এবং এ পাতকুয়া থেকে জনসাধারণ খাবার পানি ব্যবহারের পাশাপাশি সেচকাজে ব্যবহার করার সুফল ভোগ করছে। এটি খনন আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের পরিবর্তে যান্ত্রিক পাওয়ার রিগ, দৈহিক শক্তির পরিবর্তে সোলার শক্তি ব্যবহার করে পানি উত্তোলন, ফ্যানেল আকৃতির কাঠামোতে বৃষ্টির পানি ধরে তা পাতকুয়ায় নির্গমন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের মজুদ বৃদ্ধিসহ পাতকুয়াকে খাবার পানির পাশাপাশি সেচ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া শুরু হয়েছে। নলকূপগুলো থেকে আজ আর সেভাবে পনি পাওয়া যাচ্ছে না।
এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে প্রধান প্রধান হচ্ছে আম, লিচু, কলা, কুল, পেয়ারা। তবে কয়েক বছর ধরে স্ট্রবেরির চাষ এ অঞ্চলে বাড়ছে। সবজি চাষে এরই মধ্যে এ অঞ্চল অনেক অগগ্রতি লাভ করেছে। এর মধ্যে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী উপজেলায় লতিরাজ কচু, মাচায় তরমুজ চাষ, ফুল চাষ শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় পলিব্যাগ দিয়ে পেয়ারা উৎপাদন, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন, মাল্টা, ড্রাগন ফল, মুগ ডাল ব্যাপকভাবে আবাদ শুরু হয়েছে। আর এ কারণে এ অঞ্চলে পানির ঘাটতি হলে তা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণে পাতকুয়ার মতো প্রযুক্তি এখন সময়ের দাবি।
পাতকুয়া খনন ও ব্যবহারের যন্ত্রাংশ
হাইড্রোলিক পাওয়ার রিগ (বিভিন্ন কাটারসহ); আরসিসি রিং ৪০ ইঞ্চি থেকে ৫০ ইঞ্চি (চাহিদাকৃতি বয়স অনুয়ায়ী); রিং স্থাপনের জন্য উইঞ্চ (winch); ওয়ার রোপ; ৯০০ ওয়াট থেকে ১৫০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার প্যানেল; সোলার পাম্প (পানি উত্তোলনের চাহিদা অনুয়ায়ী ক্ষমতাসম্পন্ন); ২০০০ লিটার থেকে ৩০০০ লিটার ধারণক্ষমতার ওয়াটার ট্যাঙ্ক; শস্য উৎপাদনের জন্য ভূ-গর্ভস্থ নালা (১ ইঞ্চি থেকে ১.৫ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ) প্রায় ৩৫০ মিটার (ইউপিভিসি পাইপ); সেচ কাজের জন্য পানি সরবরাহ টাপ স্ট্যান্ড (৮-১০টি); খাবার-গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারকল্পে পানির ট্যাপ (প্রয়োজনমতো); ড্রিপ (Drip) স্প্রিংকলার (Sprinkler) পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যে ফ্রেক্সিবল পাউপ ইমিউর অন্যান্য যন্ত্রাংশ।
পাতকুয়া খনন করার জন্য প্রথমে রিগ মেশিনের সাথে সংযুক্ত ড্রিলিং রডের নিম্ন প্রান্তে ৫০ ইঞ্চি থেকে ৫২ ইঞ্চি ডায়ার কাটার লাগানো হয়। যান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে হাউড্রোলিক পদ্ধতিতে কাটারকে ঘুরিয়ে মাটি কাটা হয়। খননকৃত মাটিকে পানির সাথে মিশ্রিত করে রির্ভাস সার্কুলেশন পদ্ধতিতে কাদা পাম্পের সাহায্যে তোলা হয়। এভাবে কাক্ষিত গভীরতায় না যাওয়া পর্যন্ত পাতকুয়া খনন কাজ অব্যাহত থাকে। খনন কাজ সম্পন্ন হলে ওয়ার রোপের সাহায্যে আরসিসি রিং পর্যায়ক্রমে নিচ থেকে ওপরের দিকে স্থাপন করা হয়। এভাবে পাতকুয়া তৈরি করা হয়।
পাতকুয়া খননের পর পাতকুয়ায় জমা পানি উত্তোলনের জন্য সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদিত সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাম্পের সাহায্যে পানি হেডার ট্যাঙ্কে উত্তোলন করা হয়। হেডার ট্যাঙ্কে উত্তোলিত পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে সেচ, খাবার পানি গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি পাতকুয়ার ৩৫০ মিটার পাইপলাইন থাকে। এ পাইপলাইনে মাঝে মাঝে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আউটলেট নির্মাণ করা থাকে। সেখান থেকে পাশের জমিতে সরাসরি এবং দূরের জমিতে ফিতা পাইপের মাধ্যমে ফসলে সেচ দেয়া হয়। এছাড়া খাবার পানির জন্য কুয়ার পাশে একাধিক ট্যাপ স্থাপন করা আছে। সেখান থেকে স্থানীয় জনসাধারণ খরায় ও গৃহস্থালি কাজে পানি ব্যবহার করে থাকে।
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার চশসহবত মৌজায় একটি পাতকুয়া খননপূর্বক সৌরশক্তির সাহায্যে পানি উত্তোলনের জন্যে সোলার পাম্প স্থাপন করা হয়েছে, যার বিবরণ হলো-
কুয়ার গভীরতা : ৭০ ফুট; কুয়ার ব্যাস ৪৪ ইঞ্চি; রিংয়ের গভীরতা ৭০ ফুট + ৩ ফুট (প্লাট ফর্মের উপরে); সোলার প্যানেল ৯০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন (প্যানেল ৬টি); প্যাম্পের ডিসচার্জ : ১ লিটার / সে.; প্রতিদিন প্রাপ্ত পানির পরিমাণ : ১৫০০০ থেকে ১৮০০০ লিটার; পাতকুয়া খননের ব্যয় : ৪.৫০ লাখ টাকা; পাম্পসহ সোলার প্যানেল স্থাপন ব্যয় : ৪.১৫ লাখ টাকা; পাইপলাইন নির্মাণ ব্যয়: ১.২৫ লাখ টাকা। (সূত্র : বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেট)
পাককুয়া ব্যবহারের সুফল অনেক। এটি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমায় কারণ এ অঞ্চলে যত বেশি গভীর নলকূপের ব্যবহার কমানো যায় ততই মঙ্গল। এছাড়া খরার সময় খরাপ্রবণ এলাকায় স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন ধরে রাখা যায়। বিশেষ করে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা এসবের আবাদের জন্য। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার রোধ করে জলবায়ু পারিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব রোধ করা সম্ভব। আর বেশি বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি করানো এবং সংরক্ষণ করা যায়। পাতকুয়া ব্যবহারে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার করা সম্ভব। আর এর সাথে স্থানীয় জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করানো সম্ভব। যেহেতু পাতকুয়ার পানি উত্তোলন কাজে বিদ্যুৎ শক্তির পরিবর্তে সৌরশক্তি ব্যবহার হয় সেহেতু এটি পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে সহায়ক। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি হুমকির মুখে পড়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে। সেজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণাসহ কৃষিতে নানামুখী উদ্যোগ। পাতকুয়ার মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যদি আরও ব্যবহৃত হয় তবে এ এলাকার কৃষিতে নতুন আলোর সন্ধান দিবে এটি অবশ্যম্ভাবী।
কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, রাজশাহী